২৯-মার্চ-২০২৪
২৯-মার্চ-২০২৪
Logo
কৃষি

কৃষি বিপ্লব ত্বরান্বিত করবে পদ্মা সেতু

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিতঃ ২০২২-০৮-০৩ ১৮:৫৮:৪১
...

ড. জাহাঙ্গীর আলম

স্বপ্নের পদ্মা সেতু।  ২৫ জুন সকাল ১০টায় এর উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  এরপর দিন থেকেই সেতুটির ওপর দিয়ে শুরু হয়েছে সকল প্রকার যান চলাচল।  তাতে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হলো।  এতদিন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে রাজধানী থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল খরস্রোতা পদ্মা।  এই সেতুর কারণে মানুষের দীর্ঘ নৌপথের যাত্রার প্রয়োজন ফুরাবে।  তাদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে নতুন অধ্যায়।  তাদের ভোগান্তি ও সময়ের অপচয় কম হবে।  মাত্র ৪-৫ ঘণ্টার মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে ঢাকা পৌঁছে যাবে যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী ট্রাক।  ফলে সারা দেশের সঙ্গে ওই অঞ্চলের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন সুদৃঢ় হবে।  কৃষি, শিল্প ও পর্যটন খাতে সাধিত হবে ব্যাপক উন্নয়ন।  ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন দুয়ার খুলবে।  শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ সম্প্রসারিত হবে।  মানুষের আয় বৃদ্ধি পাবে।  ফলে চাঙ্গা হবে স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতি।  প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে সারা দেশের মানুষ।   

এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের হিসেবে এ সেতুর ফলে দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ এবং আঞ্চলিক জিডিপি ২.৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে।  অন্য এক হিসেবে সারা দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যাবে ২.২ শতাংশে।  তাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে।  দারিদ্র্যের হার হ্রাস পাবে প্রায়ে ১ শতাংশ করে।  দেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও অর্থায়ন ত্বরান্বিত হবে।  উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ।  তাদের জীবনধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আনবে এই বহুমুখী পদ্মা সেতু।  এ সেতুটি আমাদের গর্বের স্থাপনা।  সক্ষমতার প্রতীক।  এত বড় একটি প্রকল্প নিজ অর্থায়নে সম্পন্ন করে বাংলাদেশ আর্থিক ও কারিগরি সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে বিশ্ববাসীর সামনে।  এটি আমাদের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে।  

পদ্মা সেতুর কারণে দেশের মানুষের যে উপকার হবে তা সীমাহীন।  এতে পরিবহন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়বে।  মানুষের চলাচল বৃদ্ধি পাবে।  পণ্য পরিবহন সহজ হবে।  মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হবে।  কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়বে।  কৃষির বিভিন্ন উপখাতে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন।  আমাদের সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে কৃষি বিপ্লব বিকাশের কথা বলা হয়েছে।  গত পঞ্চাশ বছরে দেশের অন্য অঞ্চলে তার অনেকটাই সফল হয়েছে।  কিন্তু এ লক্ষ্যে পিছিয়ে আছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল।  এর প্রধান কারণ হলো যোগাযোগের অসুবিধা।  উপকরণ পরিবহনে দীর্ঘসূত্রিতা।  উৎপাদিত পণ্য বিপণনের দুর্ভোগ।  ফসলের মূল্যে অন্যায্যতা।  চাষাবাদে কৃষকের কম লাভজনকতা।  এসব কারণে ওই অঞ্চলে শস্য নিবিড়তা অপেক্ষকৃত কম।  পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে এ অঞ্চলে কৃষি বিপ্লবের অভিপ্রায় সফল হবে।  নতুন প্রযুক্তি ধারণ ত্বরান্বিত হবে।  দ্রুত বেড়ে যাবে শস্যের উৎপাদন।  গড়ে উঠবে কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা।  তাতে মানুষের কর্মসংস্থান হবে।  আয় বাড়বে।  পদ্মা সেতুর কুলঘেঁষে থাকা শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুরে রয়েছে ফসল চাষের বিস্তীর্ণ জমি।  শাকসবজি ও মসলা ফসল উৎপাদনের জন্য এসব জমি খুবই উপযোগী।  ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সংগে যোগাযোগ উন্নত হওয়ায় এখানে ফসলের পচনশীলতা হ্রাস পাবে।  বিভিন্ন শাকসবজি এবং মসলা ফসলের, বিশেষ করে পেঁয়াজ ও রসুনের উৎপাদন বাড়বে।  তাছাড়া এখানকার গুরুত্বপূর্ণ ফসল পাট চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়বে।  উৎসাহিত হবে পাটের উৎপাদন।  গড়ে উঠবে পাটভিত্তিক শিল্প।   

দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে বলা হয় খাদ্য ভাণ্ডার।  কিন্তু এই সুযোগ এতদিন পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি।  এখন যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নের ফলে সেখানে সবুজ বিপ্লব ত্বরান্বিত হবে।  ধানের ঘাতসহিঞ্চু ও উচ্চফলনশীল নতুন জাতসমূহের বিস্তার ঘটবে।  ফলে চাল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।  বরিশাল ও পটুয়াখালীতে তরমুজের চাষ হয়।  কিন্তু ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবং রক্ষণাবেক্ষণের অসুবিধাসহ বিপণন সমস্যার কারণে কৃষক তরমুজচাষে তেমন লাভবান হন না।  এখন এ সমস্যা দূর হবে এবং ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত তরমুজ প্রেরণ করা সম্ভব হবে।  তাতে কৃষকদের তরমুজ বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিশ্চিত হবে।  দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ চরে নারিকেল ও সুপারির চাষ হয়।  সমতলে হয় পান ও তেজপাতার চাষ।  পটুয়াখালীতে মুগডালের চাষ হয় বাণিজ্যিকভাবে।  জাপানসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে তা রপ্তানি করা হয়।  তাছাড়া প্রচুর ফুলের চাষ হয় যশোরে।  এখানকার ফুল রপ্তানি হয় বিদেশেও।  পদ্মা সেতুর ফলে এসব কৃষিপণ্যের চাষ উৎসাহিত হবে।

যশোর ও ফরিদপুরের খেজুর গুড়ের কদর আছে দেশজুড়ে।  এখন বিপণন ব্যবস্থার উন্নতি হলে সেখানে বাণিজ্যিকভাবে খেজুর গাছের চাষ হবে।  খেজুরের গুড়ভিক্তিক কুটির শিল্প সম্প্রসারিত হবে।  পিরোজপুরে নারিকেলের ছোবড়ার তৈরি পাপোষ ও দড়ি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি বিদেশেও বিপণন করা হয়।  এখন যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নের ফলে এ শিল্পের বিকাশ ঘটবে।  পদ্মা সেতুর কারণে জায়গা-জমির দাম অনেক বেড়ে গেছে।

পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দুগ্ধ ও মাংস শিল্প বিকশিত হবে।  গরু মোটাজাতাকরণ কর্মসূচি দ্রুত এগিয়ে যাবে।  অনেক দুগ্ধ খামার গড়ে উঠবে।  মাদারীপুরের টেকেরহাট এখন দুগ্ধ উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত।  এর পরিধি শরীয়তপুর, ফরিদপুর এবং গোপালগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃৃত হবে।  তাছাড়া পোলট্রি শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে।  দানাদার খাদ্য সহজে পরিবহন করার কারণে এর মূল্য হ্রাস পাবে।  খামারিরা প্রাণি-পাখি প্রতিপালনে আগ্রহী হবে।  দুধ ও মাংস প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিকাশ ঘটবে।  তাতে বৃদ্ধি পাবে খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের কর্মসংস্থান।

দেশের দক্ষিণাঞ্চল মৎস্য চাষ ও আহরণের জন্য খুবই গুরুপূর্ণ।  এ দেশে উৎপাদিত চিংড়ি ও সামুদ্রিক মাছের সরবরাহ আসে মূলত দক্ষিণাঞ্চল থেকে।  সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে আছে অসংখ্য মাছের ঘের।  সেখানে গড়ে উঠেছে অনেক প্রক্রিয়াকরণ শিল্প।  তাতে কাজ করছে অসংখ্য গরিব মানুষ।  পদ্মা সেতুর ফলে নিবিড় মৎস্য চাষ উৎসাহিত হবে।  রেণুপোনাসহ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।  ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিদেশে মৎস্য প্রেরণ সহজ ও ঝুঁকিমুক্ত হবে।  তাতে মাছের অপচয় হ্রাস পাবে।  আয় বাড়বে মৎস্যচাষিদের।  তাছাড়া সুনীল অর্থনীতি গতিময় হবে।  সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।  অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক আয় বৃদ্ধি পাবে মৎস্য খাতের।  

পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুুষের কাজের ক্ষেত্র অনেক সম্প্রাসারিত হবে।  কৃষি বহুধাকরণ ও শস্যের বৈচিত্র্যকরণ সহজ হবে।  কৃষি ব্যবসায় মানুষের আগ্রহ বাড়বে।  উপযুক্ত কাজ ও আয়ের অভাবে যারা নিজের এলাকা ছেড়ে ঢাকা বা অন্য কোনো এলাকায় চলে গিয়েছিলেন তারা নিজ ঘরবাড়িতে ফিরে আসবেন।  আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ নেবেন।  তাদের উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি পাবে।  দক্ষতা অর্জিত হবে।  বিভিন্ন অর্থ উপার্জনের কাজে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে।  ইপিজেড, পাটকল, চালকল পুরো মাত্রায় বিকশিত হবে।  মংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে।  তাতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।  সুন্দরবন ও সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটায় পর্যটন শিল্প বিকশিত হবে।  ফলে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল।  এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

লেখক : বিশিষ্ট কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক,

শিক্ষাবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধ

মোবাইল : ০১৭১৪২০৪৯১০