২৯-মার্চ-২০২৪
২৯-মার্চ-২০২৪
Logo
জাতীয়

ফাঁদে পড়বে না বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিতঃ ২০২২-০৯-২২ ১৪:১৫:৫২
...

দিন দিন ঘোলা হয়ে উঠছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি।  ওপারে অবিরাম চক্কর দিচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যুদ্ধ বিমান ও হেলিকপ্টার। কখনও তারা সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশ সীমায়।  ওপাশের মুহুর্মুহু গোলা ও মর্টার শেলের কোনো কোনোটি সীমান্ত পেরিয়ে এসে পড়ছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ভেতরে।  এতে তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক।  ঘটছে হতাহতের ঘটনা।  সীমান্ত এলাকা থেকে মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। 

ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে ইতিমধ্যে চার দফায় এসব ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।  কিন্তু এতে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।  এই পরিস্থিতিতে কোন পথে যাবে বাংলাদেশ।  দিনের পর দিন মিয়ানমারের সীমানা লঙ্ঘনের ঘটনায় বিকল্প কী পথ খোলা রয়েছে বাংলাদেশের।  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিমধ্যে একাধিকবার বলেছেন, বিষয়টি বাংলাদেশ জাতিসংঘে উত্থাপন করবে। 

কূটনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, কূটনীতিককে বার বার তলবই এ ক্ষেত্রে সঠিক পথ।  কারণ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে ও আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার থমকে দিতে কৌশলী পথ বেছে নিয়েছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। তারা বারবার যুদ্ধের উসকানি দিয়ে বাংলাদেশকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে।  সেটা উপেক্ষা করে বাংলাদেশ হাঁটছে চিরায়াত শান্তির পথে। 

ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খোরশেদ আলম সম্প্রতি বলেছিলেন, বারবার প্রতিবাদ জানিয়েও মিয়ানমারের সমস্যা সমাধান করা যাচ্ছে না।  মিয়ানমার এই বিষয়ে যে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক। প্রতিবেশি হিসেবে আমরা চাই না এর পুনরাবৃত্তি ঘটুক।  আমরা এভাবে এসব ঘটনা থেকে কীভাবে মিয়ানমারকে বিরত রাখা যায়, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাব। 

গত এক মাসে চারবার ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে তলব করে বাংলাদেশ।  তবে সবশেষ তলবের কূটনৈতিক ভাষা একটু ভিন্ন ছিল।  কারণ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিয়ানমারের দূতকে ১৫ মিনিট অপেক্ষায় রাখেন মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক নাজমুল হুদা।  এরপর কোনো সৌজন্যতাই দেখানো হয়নি তাকে।  দেয়া হয়নি এক কাপ চাও। 

গত সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, প্রতিবাদের ভাষা সব সময় এক রকম হয় না।  অনেক সময় শারীরিক ভাষায়ও বিরক্তি প্রকাশ করা যায়।  তবে বিশ্লেষকদের অনেকেই বাংলাদেশের এই অবস্থানকে ‘নতজানু কূটনীতি’ বলে মনে করেন। 

এ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব বলেন, যে বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়েছি, তাতে কোনো উইকনেস বা দুর্বলতা নেই।  যা অনেকেই নতজানু বলে থাকেন, তার কোনো কিছুই আমাদের বক্তব্যে নেই।  সে ধরনের কথাই আমরা বলছি, যা আমাদের শক্ত অবস্থানকেই তুলে ধরে। 

সাবেক মেজর জেনারেল এবং অধ্যাপক ড. আমিনুল করিম বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে তাদের সেনাবাহিনী এবং বিদ্রোহি গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে যুদ্ধ চলছে।  এ কারণে ওদের দিক থেকে গোলা ছোড়ার ঘটনা ঘটছে।  আমার মনে হয় মিয়ানমার ইচ্ছা করে এমন গোলা ফেলছে না।  তবে তাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বাংলাদেশ কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। 

তিনি বলেন, কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এই বিষয়ে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছে।  কিন্তু যেহেতু গোলা পড়া থামছে না, তাই বাংলাদেশ কিছু করছে না কেন তা আমি বুঝতে পারছি না।  ওরা যখন ওদের এয়ারক্রাফট আমাদের সীমানায় উড়িয়েছিল, তখন আমাদের দিক থেকেও হেলিকপ্টার ওড়ানো প্রয়োজন ছিল।  এখন আমাদের সীমান্তে অ্যাক্টিভিটি শো করা প্রয়োজন।  সীমান্তে শক্তি প্রদর্শন করা, সেনাবাহিনী নিয়োগ, নৌবাহিনীর জাহাজ মোতায়েন প্রয়োজন। 

এদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমডোর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, মিয়ানমার যা করছে, বিষয়টি আমাদের জন্য দুঃসংবাদ।  এমন পরিস্থিতিতে আমাদের উচিত হবে ‘ফরোয়ার্ড ডিপ্লয়মেন্টের’।  এ ক্ষেত্রে আমরা সেনাবাহিনীকে সীমান্তের আরো কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারি।  সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ মহড়াও করা যেতে পারে।  এতে তারা বুঝতে পারবে, আমরাও প্রস্তুত আছি যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায়। 

তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারি।  তিনি বলেন, সীমান্তে মিয়ানমারের চলমান কর্মকাণ্ড থামাতে না পারার পেছনে আমি সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাব দেখছি।  কয়েক দশক আগেও সীমান্তে মিয়ানমার এমন কর্মকা্ল ঘটিয়েছিল।  মিয়ানমারের কর্মকাণ্ড থামাতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তখন মিয়ানমারের ৩০ মাইল ভেতরে ঢুকেছিল, চীনের অনুরোধে বাংলাদেশের সেনারা আবার ফিরে আসে। 

 

সাবেক মেজর জেনারেল এবং মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে মো. শাহিদুল হক বলেন, সীমান্তের পরিস্থিতি খুব উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।  সীমান্তের বাসিন্দারা ভয়ে সীমান্ত অঞ্চল ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যাচ্ছে।  এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আরাকান আর্মির প্রতি বাংলাদেশের শক্ত বার্তা দেয়া প্রয়োজন।  স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত তাদের আওতায় সব বাহিনী ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনা করে পদক্ষেপ নেয়া। 

তিনি বলেন, মিয়ানমার এর আগে যখন চীন, থাইল্যান্ড এসব প্রতিবেশির আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল, তারপরে কিন্তু মিয়ানমার এমন ঘটনার জন্য তাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল।  কারণ থাইল্যান্ডে যখন মিয়ানমার একটা গোলা ছুড়েছিল, তখন থাইল্যান্ডের বাহিনী এর জবাবে ১০টি গোলা ছোড়ে। 

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে তারা (মিয়ানমার) আমাদের উসকানি দিতে চায়, যাতে আমরাও সামরিক দিক থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি। বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারের সঙ্গে সামরিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাতে মিয়ানমারেরই লাভ।  তারা এ ইস্যুটি ব্যবহার করে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথ আটকে দিতে চায়।  সে জন্য মিয়ানমারের সব আচরণে বাংলাদেশ সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে আসছে। 

অন্যদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং সাবেক মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ মনে করেন, ‘সীমান্তে মিয়ানমারের চলমান কর্মকা্লে আমি কোনো কূটনৈতিক ব্যর্থতা দেখি না।  মিয়ানমার তাদের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে দমন করছে।  আমাদের সঙ্গে তাদের যে প্রশ্ন, সেটা হচ্ছে, তারা তাদের লড়াই অভ্যন্তরীণভাবে করুক, কিন্তু লড়াইয়ের ফলে মিয়ানমারের দিক থেকে যে মর্টার শেল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়ছে, তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং এর দায়ভার মিয়ানমারকে বহন করতে হবে।  ডিফেন্সের ভাষায় মিয়ানমার “মিলিটারি এসকেলেশন” করছে। বর্তমান অবস্থায় মিয়ানমার সংকটের দ্বিপক্ষীয় সমাধান দেখছি না। বাংলাদেশের উচিত বিষয়টি বহুপক্ষীয় ফোরামে উপস্থাপন করা।  পাশাপাশি যুদ্ধে জড়িত না হয়ে বাংলাদেশের উচিত সামরিক শক্তি প্রদর্শন করা, যাতে কূটনীতির ভাষা এবং শক্তির ভাষা একসঙ্গে কাজ করে। 

 

তিনি বলেন, এ সমস্যা সমাধানে যারা উসকানি বা ইন্ধন দিয়েছে, তাদের কাছেই আমরা সমাধান খুঁজে যাচ্ছি।  তবে যতদিন না তাদের কৌশলগত উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো সমাধান হবে বলে আমি মনে করি না।  কিছু দেশ আমাদের দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের পথে হাঁটতে বলেছে।  যদিও সে পথে হেঁটে কোনো ফল আসেনি।  তাই তাদের পরামর্শ উদ্দেশ্যমূলক ছিল কিনা, এমন ধারণা তৈরি হচ্ছে।  আবার পশ্চিমা দেশগুলো বলেছিল, বহুপক্ষীয়ভাবে বিষয়টিকে সমাধান করতে।  যদিও এমনটি করতে হলে বিভিন্ন পরাশক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় আছে।  আমরা দ্বিপক্ষীয় না বহুপক্ষীয়ু কীভাবে যাব, এখন সেটিও একটি প্রশ্ন। তবে আমি মনে করি দ্বিপক্ষীয় চেষ্টা দিয়ে যেহেতু হয়নি, বহুপক্ষীয় উদ্যোগ দিয়ে আগামী দিনের সমাধানের পথ তৈরি করা সম্ভব হবে। 

এ নিরাপত্তা বিশ্লেষক আরও বলেন, বাংলাদেশের সীমান্তে বারবার গোলা নিক্ষেপের ঘটনাটিকে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির প্রতি মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার যে শ্রদ্ধাশীল নয়, তার বহিঃপ্রকাশ।  তারা কূটনৈতিক ভাষা বোঝে না, বা হয়তো বোঝার চেষ্টাও করে না।  এমন পরিস্থিতিতে চলমান যে সংকট তারা তৈরি করেছে, সে বিষয়ে বাধা বা প্রতিবাদ করতে গেলে কোন ভাষায় কথা বললে মিয়ানমার শুনবে, তা বুঝে সে ভাষাতেই কথা বলতে হবে। 

তিনি বলেন, এমন ঘটনার পেছনে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো দুটি বিষয় এখন অনুমেয়।  প্রথমত মিয়ানমারের ভেতর যে গৃহযুদ্ধ চলছে, তা চলার কারণে সে দেশের অখ্লতা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।  অর্থাৎ দেশটি ভেঙে যাওয়ার একটি আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।  এখন সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে যদি বৈরি কোনো দেশের সঙ্গে সংঘাত শুরু করা যায়, তাহলে জনগণের দৃষ্টি সেদিকে দিয়ে অখ্লতা রক্ষার লড়াইয়ের দিকে তারা জনমত তৈরি করতে পারে।  দ্বিতীয়ত এ অঞ্চলে বা বিশ্বে কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।  আর তা হয়েছে এ সরকারের ক্রমান্বয়ে উন্নয়ন ও স্বনির্ভরতা অর্জনের মধ্য দিয়ে।  এখন এরকম ঘটনা মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়া গেলে আমাদের যে সক্ষমতা তৈরি হয়েছে, তা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।